ক্যু বা অভ্যুত্থান হলো একটি ছোট গোষ্ঠীর দ্বারা বিদ্যমান সরকারকে আকস্মিক বা সহিংস উপায়ে উৎখাত করা। ‘অভ্যুত্থান’ শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ Coup (ক্যু) থেকে। যার অর্থ আকস্মিকভাবে সরকারের বিরুদ্ধে অবরোধ করা। অনানুষ্ঠানিকভাবে অভ্যুত্থান বা ক্যু শব্দটি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়ে থাকে।
১৭৯৯ সালের অক্টোবরে আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ক্যু হয়। মিসরে সামরিক অভিযান থেকে ফিরে আসার পর ফরাসি সামরিক নেতা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ফ্রান্সের ক্ষমতায় বসা পাঁচ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদকে উৎখাতের পরিকল্পনা করেন। ওই পাঁচ পরিচালকের দুজন এবং বেশ কয়েকজন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নেপোলিয়নের ষড়যন্ত্রে সমর্থন দেয়।
নেপোলিয়ন ১০ নভেম্বর ১৭৯৯ প্যারিসের বাইরে একটি বিশেষ আইনসভার অধিবেশনের ব্যবস্থা করেন। নেপোলিয়ন ভেবেছিলেন ঘুষ এবং ভয় দেখিয়ে আইনসভা তাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। তবে এর পরিবর্তে তাকে গালাগাল দিয়ে স্লোগান ওঠে এবং তাড়া করা হয়। তবে নেপোলিয়ন সৈন্যদের নিজের পক্ষে আনতে সক্ষম হন। ধীরে ধীরে তিনি আইনসভায় যুক্ত হন, পরিচালকদের সেখান থেকে অপসারণ করেন। সর্বশেষ নেপোলিয়ন ১৮০৪ সালে সকল ক্ষমতা একত্রিত করে নিজেই সম্রাট হয়ে ওঠেন
গণ-অভ্যুত্থান
সাধারণভাবে এমন এক পরিস্থিতিকে গণ-অভ্যুত্থান (Mass Upsurge) বলা হয় যেখানে ক্ষমতায় থাকা লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একদল লোক একত্র হয়। তারা ধীরে ধীরে আন্দোলন গড়ে তোলে এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের গদিচ্যুত করতে পারে। এ ধরনের আন্দোলনে সব শ্রেণি- পেশার মানুষ অংশ নেয়।
যে কারণে এ অভ্যুত্থানের সঙ্গে গণ শব্দটি যুক্ত হয়। তবে শুরুতে হয়তো সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে অংশ নেয় না। কিন্তু এ অভ্যুত্থানে এমন দাবি ওঠে যা সরাসরি রাষ্ট্রের কোনো না কোনো অংশের জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করে। তবে সাধারণভাবে তাদের দাবি-দাওয়ার প্রতি ক্ষমতাসীনরা কর্ণপাত করতে চান না। তারা নানা ছলচাতুরী অথবা ভয়ভীতি দেখিয়ে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করেন।
দিনে দিনে যত নিপীড়ন বাড়ে, তত জনগণের সক্রিয়তাও বাড়ে এ আন্দোলনে। তবে গণ-অভ্যুত্থানের ধর্ম হলো তা এক বা দুদিনে শেষ হয়ে যায় না। বাড়তে বাড়তে একটা পর্যায়ে গিয়ে জনগণের বিশাল একটি অংশ এতে যুক্ত হয়ে যায়। আন্দোলনের দাবি-দাওয়াও পরিবর্তন হতে থাকে। মিছিলে-স্লোগানেও পরিবর্তন আসতে থাকে। নানা দিক থেকে আসা মিছিল-স্লোগান এক সময়ে সরকার পরিবর্তনের এক দফায় মিলিত হয়। গণ-অভ্যুত্থানের আরেকটি দিক হলো, নৈতিকতা, আদর্শ ও সহমর্মিতা।
বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থান
অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে একমাত্র বাংলাদেশেই গণ-অভ্যুত্থানের মতো ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশে তাত্ত্বিক, রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের মতে এ অঞ্চলে মোট পাঁচটি গণ-অভ্যুত্থান হয়। শুরুর গণ-অভ্যুত্থানটি ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। শুরুতে এটি ছাত্র আন্দোলনই ছিল। পরে তা জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়। দ্বিতীয় গণ-অভ্যুত্থান ছিল ১৯৬৯ সালে। তৃতীয়টি ছিল ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে। নব্বইয়ে এরশাদের বিরুদ্ধে চতুর্থ গণ- অভ্যুত্থান হয়। এ প্রতিটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই সরকার পরিবর্তন হয়।
১৯৫২ সালের ক্ষেত্রে সরকার পরিবর্তন সরাসরি হয়নি। দেখা যায়, বায়ান্নর আন্দোলনের পরিণতিতেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ সরকারের পতন হয়। শুধু যে সরকারের পতন হয় তা-ই নয়; মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলা থেকেও উচ্ছেদ হয়। ১৯৬৯ সালে যে গণ-অভ্যুত্থান হয় তাতে সামরিক সরকার টিকে থাকলেও আইয়ুব খানের সরকার উচ্ছেদ হয়ে ইয়াহিয়া খানের সরকার ক্ষমতায় আসে। ১৯৭১ সালে জানুয়ারি কিংবা এর আগেই ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু হয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান ঘটায় ছাত্র-জনতা।
সামরিক অভ্যুত্থান
সামরিক অভ্যুত্থান হচ্ছে — সামরিক বাহিনীর দ্বারা (বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাহায্যে) অবৈধভাবে এবং প্রকাশ্যে কোনো ক্ষমতাসীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা। রাষ্ট্রব্যবস্থার বেহালের সুযোগ নিয়ে অভ্যুত্থানের উদ্ভব হয়। দুর্নীতি, দারিদ্র্য, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন, গভীর বিভক্তি, সহিংস উগ্রবাদ একটি রাষ্ট্রকে সামরিক অভ্যুত্থানের ঝুঁকিতে ফেলে।
ব্রিটিশ লেখক কেন কনোর ও ডেভিড হেভডিচ সেনা অভ্যুত্থান ঘটার ১০টি পরিপ্রেক্ষিতের উল্লেখ করেন। এগুলো হলো— দেশটি সাবেক কোনো উপনিবেশ বা কোনো দেশের দখলে ছিল কি না; দেশটির অবস্থান গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় কি না; ধর্মীয়, জাতিগত অথবা গোত্রগত বিভক্তি; যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে তেল; ব্যাপকভিত্তিক দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি; দীর্ঘ মেয়াদে স্বৈরাচারী সরকার; বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা; ভাড়াটে সৈনিকদের পেছনে যথেষ্ট অর্থায়ন এবং অতীতে কখনো অভ্যুত্থান হয়েছে কি না।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি অভ্যুত্থান এবং পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থান হয়। এসব অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থানের কারণে বাংলাদেশের দীর্ঘ ১৮ বছরই কেটেছে প্রত্যক্ষ সামরিক শাসন এবং সেনাবাহিনীর প্রভাবে।