বুধবার, জানুয়ারি ২২, ২০২৫
18 C
Dhaka

রক্তের বিনিময়ে আশার প্রদীপ

দেশের জন্য মহান ব্রত নিয়ে আত্মত্যাগের ইতিহাস অল্প কয়েকজনই রচনা করেন। যারা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন, তারা শুধু নিজেদের জন্য নয়, পুরো জাতির জন্য এক অনুপ্রেরণা হয়ে থাকেন। তাদের এ আত্মত্যাগ তখন হয়ে দাঁড়ায় দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সমৃদ্ধির রক্ষাকবচ। এমন ব্যক্তিরা শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিক এবং নৈতিক শক্তি দিয়ে আগলে রাখেন জাতিকে। তাদের সাহসিকতা এবং নিষ্ঠা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হয়ে ওঠে আলোকবর্তিকা। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় দেশের জন্য আত্মত্যাগ করা বীরদের নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকে এবং তারা জাতির হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে এমন কিছু মহানায়কের নাম প্রোথিত হলো আমাদের হৃদয়ে।

বুকের ভিতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর

আবু সাঈদআবু সাঈদ ছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের একজন মেধাবী শিক্ষার্থী, যার চোখে ছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্নগুলো যখন অন্ধকার হতাশার সাগরে ডুবে যায় মৃত্যুই যেন তখন হয়ে ওঠে কঠিন সত্য। নির্মম অন্ধকারকে আড়াল করে নিজের বুক চিতিয়ে উদ্ধত চিত্তে আবু সাঈদ আমাদের দেখিয়ে দেয় স্বপ্ন দেখার সাহস। আবু সাঈদের জন্ম রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলা। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক ছিলেন। ১৬ জুলাই ২০২৪ আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কোটা আন্দোলনকারীরা তাকে আন্দোলনের প্রথম শহীদ বলে আখ্যায়িত করেন।

পানি লাগবে পানি মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ

১৮ জুলাই ২০২৪ যখন মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে, তখন সারা দেশে যেন বয়ে যায় শোকের ঢেউ। এই মৃত্যুর দৃশ্য আরও শত সহস্র তরুণের হৃদয়ে জ্বালিয়ে দেয় সংগ্রামের আগুন। মুগ্ধ ঢাকার উত্তরায় জন্মগ্রহণ করলেও গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তিনি ছিলেন একজন মেধাবী শিক্ষার্থী এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। তিনি একজন মুক্তপেশাজীবী এবং ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতেন। আন্দোলনের সময় মিছিলে খাবার পানি এবং বিস্কুট বিতরণ করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। মুগ্ধর মৃত্যু কোটা সংস্কার আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। ‘ভাই, পানি লাগবে কারো, পানি’-মুগ্ধের এ কথাটি এখনো সারা বাংলাদেশকে কাঁদায়।

আমরা তোমাদের ভুলব না

একগুয়ে কর্তৃত্বের কড়ার আঘাত থেকে রেহাই পায়নি সাধারণ কর্মচারী, দিনমজুর, সাংবাদিক, গাড়িচালক, কিশোর, কিশোরী। এমনকি ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাত রেহাই দেয়নি ১৭ বছরের গোলাম নাফিজকে। রিকশায় ঝুলে থাকা তার নিথর দেহের ছবি আজও আমাদের পীড়ন দেয়। বিমর্ষ চিত্তে আমাদের তাকিয়ে থাকতে হয় যখন MIST’র ইয়ামিনকে সাজোয়া যান থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়।

জীবনকে আঁকড়ে ধরার শেষ চেষ্টায় তাদের প্রকম্পিত দেহ উত্তাল করে দেয় গোটা দেশকে। চার বছরের শিশু আবদুল আহাদ, হকার মো. শাহজাহান (২৫), গাড়ি চালক দুলাল মাতবর, শিক্ষার্থী রাকিব হাসান (১২), নির্মাণশ্রমিক নুর আলম (২২), নিরাপত্তাকর্মী ইমরান খলিফা (৩৩), চিকিৎসক সজীব সরকার (৩০), মাদ্রাসা ছাত্র আব্দুল্লাহ আল মামুন (২০)সহ আরও অনেকে শহীদ হন। সব শ্রেণির, সব পেশাজীবীর, সব বয়সের মানুষকে দিতে হয়েছে জীবন। নারী, পুরুষ, শিশু কেউই বাদ যায়নি মৃত্যু তালিকা থেকে।

ক্ষমতালিপ্সু কর্তৃত্বকে টিকিয়ে রাখতে নির্মম বলির শিকার হতে হয় অসংখ্য পুলিশ সদস্যকেও। দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু আমাদের সবসময় ব্যথিত করে। কিন্তু যারা মহৎ উদ্দেশ্যকে ধারণ করে স্বেচ্ছায় জীবন দান করেন তাদের মৃত্যু শেষ নয় বরং একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। সাঈদ, মুগ্ধরা বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি নতুন প্রতিবন্ধকতা জয়ের বাধ্যবাধকতায়। আন্দোলনের শহীদেরা দায়বদ্ধ করে দেয় নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের। যে বাংলাদেশে থাকবে না কোনো বৈষম্য আর দুর্নীতি।

মৃতের হিসাব

সময়কাল ঢাকায় ঢাকার বাহিরে মোট
১৬ জুলাই-৩ আগস্ট ২৪৬ ৯৫ ৩৪১
৪-২৩ আগস্ট ১২৬ ২৯০ ৪১৬
সর্বমোট ৩৭২ ৩৮৫ ৭৫৭
নিহতদের মধ্যে : শিক্ষার্থী : ৯১ শিশু-কিশোর : ৮৯ পুলিশ : ৪৪। [তথ্যসূত্র : প্রথম আলো, ২৪ আগস্ট ২০২৪]

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

কোটা নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্মের আনুষ্ঠানিক নাম, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন‘ (Anti-discrimination Students Movement), যা ১ জুলাই ২০২৪ আত্মপ্রকাশ করে। ‘বৈষম্যবিরোধী’ কথাটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সরকারি চাকরিতে অসামঞ্জস্যপূর্ণ অগ্রাধিকারসহ কথিত দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের মানুষের মধ্যে আয়-ব্যয়ের বিপুল ব্যবধান তৈরি করা হয়। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার করা নিয়ে আন্দোলন শুরু হলেওঁ, এক পর্যায়ে নির্মমভাবে আন্দোলন দমনের প্রতিক্রিয়ায় ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে তা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। ফলস্বরূপ ৫ আগস্ট ২০২৪ শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে এ আন্দোলন সফলতার মুখ দেখে।

সমন্বয়কদের ভূমিকা

জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচিতে অংশ নেয় বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী। কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা ক্লাস, পরীক্ষা বর্জন করে লাগাতার কর্মসূচি চলে। এ আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগায়। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আবাসিক হল ও বিভাগভিত্তিক নেটওয়ার্ক তৈরি করে ছাত্ররা সংগঠিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগের সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেরাই কোটা বিরোধী পোস্টার, প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার ছাপিয়ে আন্দোলনে শরিক হন। আন্দোলনের প্রয়োজনে নিজেরাই ক্ষুদ্র তহবিল সৃষ্টি করেন। ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে ক্যাম্পাসে অবস্থিত আবাসিক হলগুলোতে সমন্বয়কারীরা গণসংযোগ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আবাসিক হলগুলোতে আন্দোলনের সমর্থনে প্রচারপত্র বিলি করেন। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে এ আন্দোলনে একক কাউকে মুখপাত্র নির্বাচন করা হয়নি। সারাদেশে আন্দোলনকে সুসংগঠিত করতে ৬৫ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়। যেখানে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ জন সমন্বয়ক রয়েছেন।

ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা

সমন্বয়ক

  • ১. নাহিদ ইসলাম,
  • ২. আসিফ মাহমুদ,
  • ৩. সারজিস আলম,
  • ৪. মাহিন সরকার,
  • ৫. আবদুল কাদের,
  • ৬. নাজমুল হাসান,
  • ৭. রিফাত রশিদ,
  • ৮. আবু বকর,
  • ৯. নুসরাত তাবাসসুম,
  • ১০. উমামা ফাতেমা,
  • ১১. আবদুল হান্নান মাসুদ, ১২. আরিফ সোহেল, ১৩. আবদুল্লাহ সালেহীন অয়ন, ১৪. হাসনাত আবদুল্লাহ, ১৫. তরিকুল ইসলাম।

ভবিষ্যতে কেমন রাষ্ট্রব্যবস্থা চায় ছাত্র-জনতা

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ছাত্র-জনতার মধ্যে একটি আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। সেটি হলো অপশাসনে দুর্বল হয়ে পড়া রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করে জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা। এছাড়াও জনগণের মধ্যে থেকে বিচার বিভাগে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন দাবি আসছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিরা যেহেতু এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আছেন, তাই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার জন্য অন্যান্য সমন্বয়ক প্রস্তুত রয়েছেন।

তারুণ্যের রাষ্ট্রচিন্তা

তারুণ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় উদারপন্থি, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ভবিষ্যৎমুখী হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। তারা এমন এক রাষ্ট্রের আশা করে যা ব্যক্তিগত অধিকার ও স্বাধীনতাকে রক্ষা করে, বৈচিত্র্যকে মূল্যায়ন করে এবং টেকসই ও ন্যায়সংগত উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলে। সকল ধরনের বৈষম্যের অবসান, আইনের শাসন, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ঘুষবিহীন সমাজ পরিচালিত হবে, যেখানে থাকবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং সুস্থধারার সহনশীল রাজনীতি। এ বিষয়গুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বর্তমানে তরুণরা সহানুভূতিশীল, প্রযুক্তিনির্ভর এবং সচেতন প্রজন্ম হিসেবে গড়ে উঠছে যারা বাংলাদেশকে আরও ভালো এবং বাসযোগ্য করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

এই সপ্তাহে জনপ্রিয়

শিল্প বিপ্লবের দেশে কয়লার অবসান

৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ বন্ধ হয়ে যায় যুক্তরাজ্যের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র...

গণহত্যার বিচারে পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক...

বিচারপতি অপসারণে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল

১৯৭২ সালে প্রণীত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬ নং অনুচ্ছেদে...

ছাত্র আন্দোলন : বিশ্ব ইতিহাসে রেকর্ড

বিশ্বে ইতিহাস বদলে দেওয়া ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের...

ছাত্র-জনতার বিজয় : শেখ হাসিনার পদত্যাগ

ছাত্র-জনতার দেশ কাঁপানো আন্দোলনে ৫ আগস্ট ২০২৪ ক্ষমতাচ্যুত হন...

বিষয়

শিল্প বিপ্লবের দেশে কয়লার অবসান

৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ বন্ধ হয়ে যায় যুক্তরাজ্যের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র...

গণহত্যার বিচারে পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক...

বিচারপতি অপসারণে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল

১৯৭২ সালে প্রণীত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬ নং অনুচ্ছেদে...

ছাত্র আন্দোলন : বিশ্ব ইতিহাসে রেকর্ড

বিশ্বে ইতিহাস বদলে দেওয়া ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের...

ছাত্র-জনতার বিজয় : শেখ হাসিনার পদত্যাগ

ছাত্র-জনতার দেশ কাঁপানো আন্দোলনে ৫ আগস্ট ২০২৪ ক্ষমতাচ্যুত হন...

গণহত্যা মানবতাবিরোধী অপরাধ

গণহত্যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Genocide। এর আরও কয়েকটি প্রতিশব্দ হলো...

বিদ্রোহে বিপ্লবে অভ্যুত্থান

ক্যু বা অভ্যুত্থান হলো একটি ছোট গোষ্ঠীর দ্বারা বিদ্যমান...

সাম্প্রতিক সাধারণ জ্ঞান সেপ্টেম্বর ২০২৪

সাম্প্রতিক সাধারণ জ্ঞান সেপ্টেম্বর ২০২৪ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন...

সম্পর্কিত নিবন্ধন

জনপ্রিয় বিভাগ