১৯৭২ সালে প্রণীত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬ নং অনুচ্ছেদে অসদাচরণ ও অক্ষমতার কারণে একজন বিচারপতিকে অপসারণের বিধান রাখা হয়। সংসদের দুই- তৃতীয়াংশ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির ওপর অপসারণের ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সংবিধান (চতুর্থ সংশোধন) আইন, ১৯৭৫-এর মাধ্যমে সংসদীয় অভিশংসন প্রথা বিলোপ করে কারণ দর্শানোর মাধ্যমে বিচারকদের অভিশংসন ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়।
১ ডিসেম্বর ১৯৭৭ এক সামরিক ফরমানের মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসনে সংসদের ক্ষমতাকে বাতিল করা হয় । ৬ এপ্রিল ১৯৭৯ সংবিধান (পঞ্চম সংশোধন আইন, ১৯৭৯-এর মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর হস্তান্তর করা হয়। ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) আইন, ২০১৪-এর মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা আবার সংসদের ওপর ন্যস্ত করা হয় ।
মামলা ও রায়
২৯ আগস্ট ২০০৫ হাইকোর্ট বিভাগ খন্দকার দেলোয়ার হোসেন বনাম ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস, ৬২ ডিএলআর (এডি) ২৯৮, মামলায় সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন। ২ ফেব্রুয়ারি ২০১০ আপিল বিভাগ হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। তবে অধিকতর স্বচ্ছতা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বিবেচনায় সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান আদালত বলবৎ রাখেন।
৩০ জুন ২০১১ সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান অপরিবর্তিত রেখে জাতীয় সংসদ পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে । তিন বছর পর ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ জাতীয় সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পুনরায় সংসদের ওপর ন্যস্ত করা হয় ।
৫ নভেম্বর ২০১৪ এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করা হয়। ৫ মে ২০১৬ হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন । ওই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সরকার আপিল করে। ৩ জুলাই ২০১৭ আদালত সর্বসম্মতি ক্রমে আপিলটি খারিজ করেন এবং ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন।
২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ঐ রায় রিভিউ চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। সর্বশেষ ২০ অক্টোবর ২০২৪ বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদ-সদস্যদের হাতে এনে সংবিধানের যে ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়, সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগ তা চূড়ান্তভাবে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে বিচারকদের অভিশংসন ক্ষমতা
৯৬। ২) এই অনুচ্ছেদের নিম্নরূপ বিধানাবলি অনুযায়ী ব্যতীত কোন বিচারককে তাঁহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইবে না।
৩) একটি সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকিবে যাহা এই অনুচ্ছেদে ‘কাউন্সিল’ বলিয়া উল্লেখিত হইবে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুইজন কর্মে প্রবীণ তাহাদের লইয়া গঠিত হইবে এবং তবে শর্ত থাকে যে, কাউন্সিল যদি কোনো সময়ে কাউন্সিলের সদস্য এইরূপ কোনো বিচারকের সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করেন, অথবা কাউন্সিলের কোনো সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন অথবা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোন কারণে কার্য করিতে অসামর্থ্য হন তাহা হইলে কাউন্সিলের যাহারা সদস্য আছেন তাহাদের পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীণ তিনিই অনুরূপ সদস্য হিসেবে কার্য করিবেন।
৪) কাউন্সিলের দায়িত্ব হইবে
ক. বিচারকগণের জন্য পালনীয় আচরণবিধি নির্ধারণ করা; এবং
খ. কোনো বিচারকের অথবা কোনো বিচারক যেরূপ পদ্ধতিতে অপসারিত হইতে পারেন সেইরূপ পদ্ধতি ব্যতীত তাঁহার পদ হইতে অপসারণযোগ্য নহেন এইরূপ অন্য কোন পদে আসীন ব্যক্তির সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করা ।
৫) যে ক্ষেত্রে কাউন্সিল অথবা অন্য কোন সূত্র হইতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এইরূপ বুঝিবার কারণ থাকে যে কোনো বিচারক
ক. শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে তাহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিতে অযোগ্য হইয়া পড়িতে পারেন, অথবা
খ. গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইতে পারেন, সেইক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করিতে ও উহার তদন্ত ফল জ্ঞাপন করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন ।
৬) কাউন্সিল তদন্ত করিবার পর রাষ্ট্রপতির নিকট যদি এইরূপ রিপোর্ট করেন যে, উহার মতে উক্ত বিচারক তাহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে অযোগ্য হইয়া পড়িয়াছেন অথবা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইয়াছেন তাহা হইলে রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা উক্ত বিচারককে তাহার পদ হইতে অপসারিত করিবেন ।
৭) এই অনুচ্ছেদের অধীনে তদন্তের উদ্দেশ্যে কাউন্সিল স্বীয় কার্য- পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করিবেন এবং পরওয়ানা জারি ও নির্বাহের ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্টের ন্যায় উহার একই ক্ষমতা থাকিবে।