গণহত্যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Genocide। এর আরও কয়েকটি প্রতিশব্দ হলো Racial killing, Massacre, Indiscriminate killing। তবে গণহত্যা বলতে Genocide কেই বোঝায়। Genocide শব্দটি গ্রিক শব্দ Genos ও ল্যাটিন শব্দ Cide’র সমন্বিত রূপ। প্রাচীন গ্রিক শব্দ Genos দ্বারা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা জাতিকে বোঝানো হয়। আর ল্যাটিন শব্দ Cide’র অর্থ ‘হত্যা করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মান নাৎসীদের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপকতা তুলে ধরে পোলিশ আইনজীবী ও অধ্যাপক রাফায়েল লেমকিন।
১৯৪৪ সালে প্রকাশিত Axis Rule in Occupied Europe : Laws of Occupation, Analysis. of Government, Proposals for Redress নামক গ্রন্থে প্রথম Genocide শব্দটি ব্যবহার করেন। ১৯৪৫ সালে আইনি পরিমণ্ডলে শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়, নাৎসি নেতাদের বিচারে নুরেমবার্গে গঠিত আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতে। রাফায়েল লেমকিনের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় ১১ ডিসেম্বর ১৯৪৬ জাতিসংঘে গণহত্যা নিষিদ্ধ করে একটি রেজ্যুলেশন পাশ হয়। এরপর ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ কনভেনশনে গণহত্যাকে একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
গণহত্যার সংজ্ঞা
গণহত্যা বলতে নির্দিষ্ট একটি ভৌগোলিক অংশে একযোগে বা অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে দুইয়ের অধিক মানুষকে মেরে ফেলা বোঝায়। আর পারিভাষিক অর্থে কোনো দেশ, জাতি, গোষ্ঠী বা ভিন্ন মতাদর্শধারীদের খুন এবং মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করাই হলো ‘গণহত্যা’। গণহত্যার সময় কোনো কিছুতে সীমাবদ্ধ থাকে না, তখন যথেচ্ছভাবে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়। সেই হত্যাকাণ্ড থেকে নারী বা শিশুও বাদ যায় না। জার্মানি ও আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, যদি ইচ্ছে করে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা করা হয় তাহলে সেটি গণহত্যা বলে বিবেচিত হতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে শব্দটি আরও বড় পরিসরে ব্যবহৃত হয়। সেখানে এমন ঘটনাকেও গণহত্যা বলা হয়, যে ঘটনায় হয়তো কেউ প্রাণ হারায়নি।
বিশ্বে উল্লেখযোগ্য গণহত্যা
নাম | সময়কাল |
গ্রিক গণহত্যা | ১৯১৩-১৯২৩ |
আর্মেনীয় গণহত্যা | ১৯১৫-১৯১৭ |
দ্য হলোকস্ট | ১৯৪১-১৯৪৫ |
একাত্তরের গণহত্যা | ১৯৭১ |
কম্বোডীয় গণহত্যা | ১৯৭৫-১৯৭৯ |
রুয়ান্ডা গণহত্যা | ১৯৯৪ |
বসনিয়ান গণহত্যা | ১৯৯৫ |
রোহিঙ্গা গণহত্যা | ২০১৬-২০১৭ |
গাজা গণহত্যা | ২০২৩-বর্তমান |
গণহত্যা কনভেনশন
৯ ডিসেম্বর ১৯৪৮ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় অধিবেশনে Convention on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide (CPPCG) বা Genocide Convention গৃহীত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হাতে সুপরিকল্পিত জাতিহত্যার অংশ হিসেবে ৬০ লাখ ইহুদি প্রাণ হারায়। এ ঘটনা যাতে আর না ঘটে, এ উদ্দেশ্য মাথায় রেখেই আন্তর্জাতিক কনভেনশনটি প্রণয়ন করা হয়।
১২ জানুয়ারি ১৯৫১ কনভেনশনটি কার্যকর হয়। এটি জাতিসংঘের সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রথম মানবাধিকার চুক্তি। এখন পর্যন্ত ১৫৩টি দেশ এ চুক্তিকে তাদের জন্য আজ্ঞানুবর্তী আইন হিসেবে মেনে নেয়। গণহত্যা কনভেনশনের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, গণহত্যা বলতে কোনো জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, বর্ণগত অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণভাবে অথবা আংশিকভাবে ধ্বংস করার অভিপ্রায় নিয়ে করা নিম্নোক্ত কাজগুলোকে গণহত্যা বলে গণ্য করা হবে—
- ওই গোষ্ঠী (বা দলের) সদস্যদের হত্যা করা
- ওই গোষ্ঠীর সদস্যদের মারাত্মক শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা
- ইচ্ছাকৃতভাবে ওই গোষ্ঠীর জীবনের ওপর এমন অবস্থা আরোপ করা যাতে এটির সম্পূর্ণ বা আংশিক শারীরিক ধ্বংস সাধিত হয়
- ওই গোষ্ঠীর মধ্যে নতুন (শিশুর) জন্ম বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং জোরপূর্বক ওই গোষ্ঠীর শিশুদেরকে অন্য গোষ্ঠীর কাছে হস্তান্তর করা।
আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস ৯ ডিসেম্বর ১৯৪৮ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের গণহত্যা কনভেনশন গৃহীত হয়। দিনটিকে স্মরণ করে রাখতে ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এ দিবসের মূল লক্ষ্য হলো গণহত্যা বিষয়ক প্রথাটির ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং গণহত্যায় মৃত ব্যক্তিদের স্মরণ ও সম্মান করা।