বিশ্বে ইতিহাস বদলে দেওয়া ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের নেতৃত্বে সংঘটিত ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক অভূতপূর্ব মিল রয়েছে। দীর্ঘ সময়ের শাসন ক্ষমতা পরিবর্তনের মাধ্যমে ইতিহাসে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ছাত্র আন্দোলন নিয়ে আমাদের এ আয়োজন।
ছাত্র আন্দোলন
‘সত্যের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ’ এর মধ্যেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিহীত। এ শ্রেষ্ঠত্ব যুগে যুগে লুফে নেয় তরুণ ছাত্র-জনতা। একজন সচেতন ছাত্র দেশ ও জাতির সক্রিয় কার্যকর প্রতিবাদী জনশক্তি। এ তরুণ ছাত্র সমাজ যখন কোনো যৌক্তিক বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে তাকেই ছাত্র আন্দোলন বলা হয়।
বৈশ্বিক ছাত্র আন্দোলন
১৬০ সালে চীনে ইতিহাসের প্রথম ছাত্র আন্দোলন অনুষ্ঠিত হয়। চীনের ইমপেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তখন সরকারের কয়েকটি নীতির প্রতিবাদে রাস্তায় আন্দোলনে নামে। তাদের এ আন্দোলনে প্রায় ৩০,০০০ মানুষ অংশ নেয়। এরপর যুগে যুগে বিশ্ব কাঁপানো বহু আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় ছাত্ররা। তার কিছু সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো–
- তিয়েন আনমেন স্কোয়ার আন্দোলন : ১৯৮৯ সালে চীনের তিয়েন আনমেন স্কোয়ার আন্দোলনে হাজার হাজার ছাত্র এবং সাধারণ মানুষ সরকারের স্বচ্ছতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং অন্যান্য অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নামে।
- হোয়াইট রোজ আন্দোলন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে এক অহিংস প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করে। তারা প্রথমে ‘হোয়াইট রোজ’ নামের একটি গ্রুপ গঠন করে। ১৯৪৩ সালে তাদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচার শেষে ছয়জন প্রধান সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
- জাতিবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলন : দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়েতোর পাবলিক স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা জাতিবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। ১৬ জুন ১৯৭৬ জোহানেসবার্গে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেয়।
- গ্রিনসবোরো অবস্থান ধর্মঘট : যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার উলওর্থ লাঞ্চ কাউন্টারে সাদা-কালো ভেদাভেদের প্রতিবাদে কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্ররা অবস্থান ধর্মঘট শুরু করে। এ আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে। এ আন্দোলনের ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লাঞ্চ কাউন্টারগুলোতে বর্ণবৈষম্য রহিত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আইন পাশ হয়।
- ভাষা আন্দোলন : ১৯৫২ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে ঢাকায় ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনে নামে। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ ছাত্রদের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পরিণামে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়।
২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন
ছাত্ররাই অজেয়- এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়। এ সফলতা যতটা না সরকার পরিবর্তন করে দেখিয়েছে তার চেয়ে বেশি পুরো রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার বৈকল্যকে তুলে ধরেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু দেশে ছাত্র বিক্ষোভে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন আসে। যার সর্বশেষ উদাহরণ সৃষ্টি হয় বাংলাদেশে। ১ জুলাই ২০২৪ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা। এর ফলে সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি
২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন কেবল বাংলাদেশ নয় বিশ্ব ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ঘটনা হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকবে। এ আন্দোলনে তরুণ থেকে বৃদ্ধ হাতে হাত রেখে অংশগ্রহণ করে যা বিশ্বে বিরল। দুর্নীতি আর অপশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ কেবল জনসাধারণ নয়, ছাত্র সমাজের ভিতরেও তৈরি করে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও হতাশা। অধিকার আদায়ে সচেতন শিক্ষিত ছাত্রসমাজ এক সময় স্বৈরশাসন আর কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে থাকে এবং সর্বশেষ মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নেয়।
ক্ষোভ আর হতাশা যখন নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সুরাহা হয় না তখন বিপ্লবই হয়ে ওঠে অপরিহার্য নিয়তি। ২০২৪ সালে ছাত্র আন্দোলন তেমনি দেশে ইতিহাস সৃষ্টি করে বিপ্লবী পরিবর্তন নিয়ে আসে। এ আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট রিজিম পরিবর্তন করে সফল হয় ছাত্র আন্দোলন। তবে এ আন্দোলনের প্রভাব অনেক গভীর ও ব্যাপক। জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলন সবচেয়ে বড় অর্জন মানুষে মানুষে সংহতিবোধ। ছাত্র-জনতা দল তৈরি করে বাড়িঘর ও উপাসনালয় পাহারা দিতে শুরু করে। মাদ্রাসার ছাত্ররাও অনেক জায়গায় পাহারা দেয়।